ডিজিটাল মার্কেটিং এর অন্যতম প্রধান একটি সেক্টর হলো “সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং”। ৯০% পণ্যের টার্গেটেড অডিয়েন্সের আনাগোনাই থাকে সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম গুলোতে। তবে অডিয়েন্স ভেদে, তাদের চাহিদা মোতাবেক কনটেন্ট তৈরী এবং বিজনেসের প্রচার করতে চাই স্ট্র্যাটেজিক কনটেন্ট প্ল্যানিং।
শুধু তো ফেসবুক-ই না, আমাদের দেশে এখন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ইত্যাদি। সেই সুবাদে একেক প্লাটফর্মের জন্য কনটেন্ট প্ল্যানিংয়ে রাখতে হয় ভিন্নতা। কোনো প্ল্যানিং/স্ট্র্যাটেজি ছাড়া শুধু পোস্ট করে গেলে সময় ও শ্রম পন্ড হওয়াটাই নিশ্চিত। তাই আজকে আমি ডিজিটাল মার্কেটিং কনসালটেন্ট হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে জানবো কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং এর জন্য কনটেন্ট প্ল্যান করবেন।
সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট প্ল্যানিং কি?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট প্ল্যানিং হচ্ছে একটি প্রসেস, যেখানে বিজনেসের প্রচারের জন্য কনটেন্ট তৈরী এবং শিডিউল করা হয়। এই প্রসেসের মধ্য দিয়েই আপনি ঠিক করবেন সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে কি পোস্ট করবেন এবং কখন পোস্ট করবেন।
তাছাড়া পুরো মাসের প্ল্যান একবারেই করা হয় বলে প্রোমোশোনাল এবং এঙ্গেজিং পোস্ট ঠিক অনুপাতে করা যায়। এতে করে শুধু সেল পোস্ট দেখতে দেখতে কাস্টমারের বিরক্তির উদ্রেক হয়না।
কনটেন্ট প্ল্যানিং কেন করবেন!
বর্তমানে যেকোনো পণ্যের অনলাইন উপস্থিতি যতো বেশী বাড়ানো যায়, সম্ভাব্য ক্রেতাদের পণ্য কেনার সম্ভাবনা ততো হারেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। সেক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ার একেকটি পোস্ট বিজনেসকে নতুন করে পরিচিত করার সুযোগ তৈরী করে।
আবার প্রতিদিন একটি পোস্ট রেডি করা যথেষ্ঠ সময়সাপেক্ষ। অতএব একবারে পুরো মাসের কনটেন্ট প্ল্যানিং অনেকটা সময় বাঁচায়। তাছাড়া একটি ব্লগ বা ইনফোগ্রাফিক থেকে ছোটো কয়েকটা কনটেন্ট বের করা এবং রিপারপাস (repurpose) করেও দ্রুত কনটেন্ট প্ল্যানিং করে ফেলা যায়।
৫ টি ধাপে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং কনটেন্ট প্ল্যানিং-
খালি চোখে মনে হতে পারে সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট গুলো বিজনেসে তেমন পরিবর্তন আনছে না। তবে সব গুলো পোস্ট একত্রে সমন্বিতভাবে বিজনেসের উদ্দেশ্য পূরণে সাহায্য করে। এবার আমরা জানবো ৫ টি ধাপে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং কনটেন্ট প্ল্যানিং:
১। প্লাটফর্ম বাছাই
সঠিকভাবে ডিজিটাল মার্কেটিং প্ল্যান করতে গেলে একটি বিজনেসের টার্গেট অডিয়েন্সের বয়স, লিঙ্গ, আয়, লোকেশন ইত্যাদি রিসার্চ করে সেই বিজনেসের জন্য পার্ফেক্ট সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম কোনটি তা ঠিক করতে হয়। সব বিজনেসের প্রচারের জন্য সব প্লাটফর্ম নয়। যেমন B2B বিজনেসের জন্য লিংকডইন এবং ফেসবুক ভালো পারফর্ম করে, আবার ই-কমার্স বিজনেসের জন্য ইন্সটাগ্রাম বা টিকটক বেটার আউটপুট আনে।
আপনার বিজনেস এর টার্গেট অডিয়েন্স যদি হয় টিনএজার/Gen Z জেনারেশন তবে টিকটক ভালো অপশন; অন্যথায় মধ্যবয়স্ক/ millennials জেনারেশনের জন্য ফেসবুক, টুইটার বেটার প্লাটফর্ম।
২। লক্ষ্য ঠিক করা
মার্কেটিং প্ল্যান বা স্ট্র্যাটিজি তৈরী করার আগে লক্ষ্য বা গোল ঠিক করে নেয়া বাঞ্চনীয়। এত করে পারফর্মেন্স এর ফলাফলের ভিত্তিতে মার্কেটিং স্ট্র্যাটিজি সফল নাকি বিফল তা সহজেই বোঝা যায়। আপনার সোশাল মিডিয়া স্ট্র্যাটিজির গোল বা লক্ষ্য হতে পারে:
- বিক্রয় বৃদ্ধি।
- পণ্যের পরিচিতি।
- পোস্ট এঙ্গেজমেন্ট বৃদ্ধি।
- বিজনেস কেন্দ্রিক কমিউনিটি তৈরী।
- রেটিং বা রিভিউ বৃদ্ধি।
নোট: সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং স্ট্র্যাটিজি খুব সিম্পল রেখে ২-৩ টি গোল নিয়ে আগানোই রেকমেন্ডেড।
৩। রিসার্চ
ক) কমপিটিটর রিসার্চ
আপনার বিজনেসের প্রতিযোগীরা যদি ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় সফল হয়, তবে তাদের প্রোফাইল গুলো চেক করতে পারেন। ঠিক কোন ধরনের কনটেন্ট ভালো পারফর্ম করছে তা দেখে নিতে পারেন। তার মানে এই নয় যে আপনি তাদের কনটেন্ট প্ল্যান পুরোটাই কপি-পেস্ট করবেন। শুধু মাত্র আইডিয়া নিন এবং তাদের চেয়ে ভালো কনটেন্ট জেনারেট করুন। পোস্ট গুলোকে ইউনিক করতে চেষ্টা করুন।
খ) টপিক রিসার্চ
কনটেন্ট প্ল্যানিং এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পার্ট হলো টপিক রিসার্চ। টপিক রিসার্চের ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে পারেন:
- ইন্ডাস্ট্রি ট্রেন্ড।
- নতুন প্রোডাক্টের বৈশিষ্ঠ্য।
- পুরাতন প্রোডাক্টের আপডেট।
- কমিউনিটি নিউজ।
- কোম্পানি নিউজ।
- প্রোডাক্ট সম্পর্কিত শিক্ষনীয় যেকোনো তথ্য ( টিপস, টিউটোরিয়াল ইত্যাদি)।
গ) পোস্ট আইডিয়া
মার্কেটিং এ “ব্রেইনস্টোর্মিং” বিষয়টি অনেক জনপ্রিয়।আপনি ১০-১৫ মিনিট সময় নিন এবং মাথায় যা যা আইডিয়া আসে লিখে ফেলুন। আইডিয়া গুলো ভালো কি খারাপ তা নিয়ে ভাববেন না। আইডিয়া লিস্ট তৈরী হয়ে গেলে এবার কিছু ক্রাইটেরিয়ার সাথে আইডিয়াগুলোর মিল আছে কিনা দেখুন। যেমন:
- আইডিয়া গুলো আপনার বিজনেসের মার্কেটিং লক্ষ্যের (goal) সাথে সম্পর্কিত কিনা।
- আপনার টার্গেট অডিয়েন্সের সাথে রিলেট করছে কিনা।
নোট: ব্রেইনস্টোর্মিং এর ক্ষেত্রে AI বা চ্যাটজিপিটির সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
ঘ) রি-পারপাস (Repurpose)
ইতোমধ্যে আপনার ব্র্যান্ড মার্কেটিং এর জন্য যে কনটেন্ট (ব্লগ বা ভিডিও) তৈরী করেছে সেসব কনটেন্ট এর খন্ড খন্ড অংশ কে রিপারপাস করে ছোট পোস্ট তৈরী করে ফেলতে পারেন। খুব কম সময়েই একটি কনটেন্টকে ৫-৬ টি পোস্ট বানানো যায়। যেমন:
- ইন্সটাগ্রাম পোস্টের জন্য একটি স্ক্রিপ্ট লিখুন।
- এই স্ক্রিপ্ট এর মেইন পার্ট নিয়ে ছোট একটি ফেসবুক পোস্ট লিখুন।
- রিল কনটেন্ট থেকে ইমেজ বা ইনফোগ্রাফিক বানিয়ে ফেলুন।
- ভিডিওটিকে অন্য প্লাটফর্মে ব্যবহার করার জন্য রেকমেন্ডেড পোস্ট সাইজ অনুসারে তৈরী করে রাখুন। যেমন: ফেসবুক পেইজ, টিকটক, ইউটিউব শর্টস। গুগল করলেই সব প্লাটফর্মের রেকমেন্ডেড পোস্ট সাইজ পেয়ে যাবেন।
ঙ) পোস্ট করার সময় নির্ধারণ
কনটেন্ট তৈরী করার পর তা পোস্ট করার সঠিক সময় নির্বাচন করাটাও সমানভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কোন সময়ে পোস্ট করলে কনটেন্ট গুলো বেস্ট রেজাল্ট আনবে তা নির্ভূলভাবে বলা যায় না। কারন “ব্র্যান্ড বিল্ডিং কনটেন্ট” পোস্ট করার সময় এবং “সেল পোস্ট” করার সময় কখনোই এক হবে না।
তাই সঠিক সময় বের করার জন্য বিভিন্ন সময়ে পোস্ট করে পোস্টের রিচ, এঙ্গেজমেন্ট চেক করতে হবে। যে সময়ে মোট ইমপ্রেশন বেশী আসবে সেটাকেই পার্ফেক্ট সময় হিসেবে ধরে পোস্ট করে যেতে হবে।
৪। কনটেন্ট ক্যালেন্ডার
কনটেন্ট ক্যালেন্ডার তৈরী করার ফলে পুরো মাসে কি কি কনটেন্ট পোস্ট করা হবে তা এক নজরেই দেখে নেয়া যায়। সাধারন কনটেন্ট ক্যালেন্ডার বানানোর জন্য গুগল শিটই যথেষ্ঠ। সেক্ষেত্রে আপনার চাহিদানুযায়ী রো-কলাম সাজিয়ে নিতে পারবেন। যেমন: তারিখ, কনটেন্ট টপিক, পোস্ট ক্যাপশন, ইমেজ ফাইল লিংক ইত্যাদি।
আপনি যদি প্রতিদিন পোস্ট করতে চান তবে কনটেন্ট শিডিউল করে রাখার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া মেনেজমেন্ট টুল ব্যবহার করতে পাারেন। যেমন: buffer, hootsuite ইত্যাদি।
৫। কনটেন্ট ট্র্যাকিং
পরবর্তীতে কনটেন্ট প্ল্যান করার জন্য এই ধাপটি খুব প্রয়োজনীয়। শুধু কনটেন্ট পাবলিশ করে যাওয়াই মার্কেটিং টিমের একমাত্র দায়িত্ব না বরং কনটেন্ট গুলো কেমন আউটপুট নিয়ে আসছে তা ট্র্যাক করাও তাদের দায়িত্ব। সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম এর রেজাল্ট “এনালিটিকস” অপশন থেকে খুব সহজেই মনিটর করা যায়।
আর যে ধরণের কনটেন্ট কাস্টমার-রা বেশী পছন্দ করছে, বেশী এঙ্গেজমেন্ট আসছে সে ধরণের কনটেন্টগুলো কনটেন্ট ক্যালেন্ডারে রাখা যেতে পারে। এই ডাটার উপরে ভিত্তি করে কনটেন্ট স্ট্র্যাটিজিও কার্যকরী ভাবে সাজানো যায়। পারফর্মেন্স ট্র্যাক করার জন্য সাধারণ সোশ্যাল মিডিয়া মেট্রিকস গুলো হলো:
- রিচ, ইম্প্রেশন, এঙ্গেজমেন্ট।
- ক্লিক থ্রু রেইট (CTR)।
- হ্যাশট্যাগ পারফর্মেন্স।
শেষ কথা
সোশ্যাল মিডিয়া দ্রুত পরিবর্তনশীল, প্লাটফর্মগুলো নিয়মিত তাদের টুলস, ফিচার আপডেট করতে থাকে। উপরে যে টিপস এবং ট্রিকস গুলো আলোচনা করা হয়েছে তা একদম বেসিক পর্যায়ের। তাই সোশ্যাল মিডিয়া আপডেট হবার সাথে সাথে আপনাকে কনটেন্ট স্ট্র্যাটিজি, প্ল্যানেও পরিবর্তন আনতে হবে। সেই সাথে প্রতিনিয়ত ট্র্যাকিং এবং পারফর্মেন্সও পরিমাপ করতে হবে।